গর্ভবতী হওয়ার উপযুক্ত বয়স কত হওয়া উচিত?
গর্ভবতী হওয়ার উপযুক্ত বয়স:
একটা বয়সের পর প্রতিটা মেয়ের বুকে মা হওয়ার স্বপ্ন জাগরিত হয়।তবে মা হওয়ার ক্ষেত্রে বা প্রেগন্যান্সিতে বয়স খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কারণ মায়ের বয়সের উপর নির্ভর করে সন্তানের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ।
চিত্র সূত্র- pixabay.com
বয়স খুব কম হলে যেমন সন্তান ধারণের পক্ষে মায়ের নানা শারীরিক জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে, ঠিক তেমনি বয়স বেশি হয়ে গেলেও বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় হবু মায়ের।
গ্রামের দিকে একটি মেয়ের বয়স পনেরো পার হতে না হতেই তাঁকে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেন বাবা, মা।এই কিছুদিন আগেই শুনলাম আমার এক আত্মীয় জানালেন একটি মেয়ের বিয়ের কথা যাকে আমি নিজেও চিনি মেয়েটির বয়স সবে চোদ্দ বছরে পড়েছে, তার মা নেই , তাঁকে লেখা পড়া বন্ধ করিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দিয়েছে। এ সমস্ত ঘটনা শুনতে অবাক লাগলেও কিছু করার নেই।কারণ এখানে প্রতিবাদ করতে গেলে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে, যেটা সব সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না।
গবেষণা বলছে, বিশ্বে ১৪ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে গর্ভ ধারণের কারণে বছরে ৭০ হাজার মায়ের মৃত্যু ঘটে প্রসব কালীন অবস্থায়।কারণ তাঁদের শারীরিক বিকাশ ঘটে না।এছাড়া গ্রামের দিকে একটি ছেলে এবং একটি মেয়ের বয়সের ব্যবধান থাকে অনেক। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছেলেদের বয়স বেশি হওয়ায় ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটির উপর শারীরিক ও মানসিক চাপ পড়ে। কিন্তু শত সচেতনতার সত্ত্বেও এ সমস্যা দূূূর হয় না অর্থিক ও মানসিকভাবে উন্নত না হওয়ার কারণে।
কিশোরী মেয়ের নিতম্বের মধ্যেকার অস্থি কাঠামো ছোট থাকে, যেটা কুঁড়ি বছরের আগে সুন্দর ভাবে বিকশিত হয় না। তাই বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০-৩০ বছর ই একজন নারীর গর্ভধারণের সঠিক সময়।
গর্ভধারণের জন্য মায়ের বয়স ছোট হওয়া যেমন সমস্যা ঠিক তেমনই মেয়েদের বয়স যত বাড়ে, ততই তাঁর ফার্টিলিটির সম্ভবনা কমে আসে। এখন যেহেতু বিশেষ করে শহরের মহিলারা কেরিয়ার নিয়ে সচেতন তাই তাঁরা পড়াশোনা এবং কেরিয়ার তৈরি করতে ব্যস্ত থাকে তাই খুুুব তাড়াতাড়ি মা হতে চান না কেউ ই। ফলে বর্তমানে গর্ভধারণ সংক্রান্ত অন্যতম মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে মায়ের বয়স ।
এখন যাঁরা একটু সচেতন তাঁরা প্রায় আঠাশ থেকে ত্রিশ বছর বয়সে গিয়ে বিয়ে করছে।ফলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রেগন্যান্সির সময় ও পিছোচ্ছে।তবে একথা ও জেনে রাখা ভালো বয়স খুব বেশি হয়ে গেলে গর্ভধারণের জটিলতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
বয়সের সঙ্গে বাড়ে বিভিন্ন জটিলতা
একজন মেয়ে যখন বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছায়, তখন তাঁর পিরিয়ড শুরু হয়।এবং তখন থেকই সেে প্রজননে সক্ষম হয়ে ওঠে। তবে তখন কিন্তু সে শারীরিক এবং মানসিক পরিণত হয়ে ওঠে না।আবার বেশি বয়স হয়ে গেলে বাড়ে বিভিন্ন জটিলতা।আমরা মহিলারা নির্দিষ্ট সংখ্যক ওভাম নিয়ে জন্মগ্রহণ করি এবং বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাদের গুনগত মান কমতে থাকে।যার ফলে সন্তান ধারণের ক্ষমতা ক্ষীণ হয়ে আসে।
সাধারণ একটি মেয়ের ৩০ এর পর থেকেই গর্ভধারণের সম্ভবনা কমতে থাকে। ৩৭এর পর সেই হার খুব দ্রুত নামতে থাকে। নির্দিষ্ট সংখ্যক ওভাম থাকায়, বয়ঃসন্ধি থেকে প্রতিবছর ১২ টি করে ( প্রতি মাসে পিরিয়ডস চলা কালীন একটি করে ) ডিম্বাণু নষ্ট হয়ে যাওয়ায়, ৩৭ বছরে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ওভামের সংখ্যা কমে যায় এবং তার গুুুণমান কমে যায়।
তাই একটি মেয়ের ৩৭ বছর বয়সের পর প্রেগন্যান্সির সম্ভবনা এক ধাক্কায় অনেক কমে আসে। ৪০ বা ৪৪ - এর পর খুব কম মহিলায় মা হতে পারেন। আর যদি বা মা হন, তাহলে অনেক ঝুঁকি রয়ে যায়।
কারণ কেউ যদি শরীরের সঠিক যত্ন না নেয়, তাহলে তাঁর বয়স বাড়ার সাথে সাথে ডায়াবেটিস, থাইরয়েড কিংবা হার্টের সমস্যা দেখা দেয়। প্রেগন্যান্ট হওয়ার আগে এই সমস্ত সমস্যা সারাতে না পারলে তার প্রভাব সন্তানের স্বাস্থ্য ও বিকাশের উপর পড়ে।
মায়ের বয়স যত বাড়ে, তত সন্তানের মধ্যে ক্রোমোজোমাল অ্যাবারেশন, মেন্টাল রিটারডেশন , ফিজিক্যাল অ্যান্ড মেন্টাল ডিজএবিলিটির আশঙ্কা বাড়ে। এছাড়া ওভামের কোয়ালিটি ভাল না হলে, মিসক্যারেজের আশঙ্কা থাকে। রক্তে শর্করার পরিমাণ বেেশি হলে ক্ষতি হতে পারে সন্তানের।
তাই কেরিয়ার, পড়াশোনা বা ব্যক্তিগতভাবে নিজের সব চাহিদাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে খুব বেশি দেরি হলে প্রেগন্যান্সি তে সমস্যা আসতে পারে। তাই সব কিছুর মধ্যে একটা ব্যালান্স থাকা প্রয়োজন।
দ্বিতীয়বার গর্ভধারণের ক্ষেত্রে
প্রথমবার মা হওয়ার সময় ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে।কারণ তখন মায়ের মনে অনেক ভয় কাজ করে।গর্ভাবস্থায় মায়ের মানসিক ও শারীরিক অবস্থা কেমন থাকবে কোথায় কোন সমস্যা হবে কি না ইত্যাদি কিছুই অনুমান করা যায় না।সেই কারণেই প্রথমবারের থেকে দ্বিতীয় বার মা হওয়ার সময় ভয়ের তেমন কিছু থাকে না।তবে যাঁদের শারীরিক সমস্যা থাকে তাঁদের ব্যাপার টা আলাদা।
বাবার বয়সের কি কোন প্রভাব পড়ে?
এটা অনেক মতভেদ আছে। তবে এক্ষেত্রে গবেষণা বলে একজন পুরুষ নারীর তুলনায় বেশি বয়স পর্যন্ত একটি সুস্থ সন্তান জন্ম দিতে সক্ষম থাকে, সে যদি শারীরিক সুস্থ থাকে তবে।
প্রেগন্যান্সির সঠিক সময় কখন?
সোস্যাল ফ্যাক্টর এবং ফার্টিলিটি ব্যালন্স করতে গেলে, মিড টোয়েন্টি থেকে আর্লি থার্টিজের মধ্যে সন্তান ধারণের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।এতে কেরিয়ার এবং সুন্দর লাইফস্টাইল দুটোই সামলানো যায়।
তবে আর একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, সেটা হল বাচ্চা নেওয়ার আগে অর্থনৈতিক সবলম্বন। একটা বাচ্চা মানুষ করতে গেলে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। তাই এটা আগে ভাবতে হবে । এছাড়া আছে বাবা মায়ের মানসিক প্রস্তুতি।
চিত্র সূত্র- pixabay.com
আরও পড়ুন: বাচ্চা নেওয়ার আগে মায়ের প্রস্তুতি
জীবনযাপনের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত?
গর্ভবস্থা স্বাভাবিক রাখতে সুস্থ লাইফস্টাইলের ভূমিকা অপরিসীম।এই সময় হবু মা কে সব সময় আনন্দে থাকতে হবে। তাঁর হাসি খুশি তে রাখা টা বাড়ির সকলের প্রধান কর্তব্য হওয়া উচিত। অবশ্য সবার থেকে এখানে বাবার ভূমিকা থাকবে বেশি।
মায়ের ওজন বেশি হলে, পিরিয়ড অনিয়মিত হলে অনেক সময় সমস্যা দেখা দেয়।তবে সব ক্ষেত্রেই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে।আর চাই কাছের মানুষের একটু সহযোগিতা।
মাতৃত্ব কে সহজ ভাবে গ্রহণ করুন
মাতৃত্ব নারী জীবনের পূর্ণতা আনে। সাধারণ মানুষ থেকে সেলিব্রিটি সকলেই মাতৃত্ব কে উপভোগ করে। মা শব্দটির মধ্যে একটি মিষ্টি আবেগ লুকিয়ে আছে তাই এর স্বাদ সকলেই পেতে চাই।
তবে সন্তান নিতে হলে সচেতন ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ ব্যাপারে যথেষ্ট সেনসিবল হওয়া জরুরী। এখন মাতৃত্ব ধারণে যদি একটু দেরি হয়ে যায় তবে চিন্তার কোন কারণ নেই। এখন চিকিৎসা বিজ্ঞান অনেক উন্নত। নানা ধরনের মেডিকেল টেকনোলজি আছে , যার মাধ্যমে প্রেগন্যান্সি- সংক্রান্ত সমস্ত সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।
তবে প্রাকৃতিক পদ্ধতির মতো নিরাপদ এবং সুনিশ্চিত উপায় আর কিছুতেই নেই। তাই যে মা স্বাভাবিকভাবেই সুস্থ, সবল তাঁর প্রাকৃতিক পদ্ধতিতেই সন্তান ধারণের চেষ্টা করা উচিত।
চিত্র সূত্র- pixabay.com
উপসংহার
পরিশেষে একটা কথাই বলার, পেশা, ব্যক্তিগত জীবন, নিজের ইচ্ছে ইত্যাদি কে অবশ্যই প্রাধান্যে দিন, তবে মাতৃত্ব কে উপেক্ষা করে নয়। আসলে মা হওয়ার উপযুক্ত সময় বা বয়স বলে নির্দিষ্ট কোন দিন ক্ষণ নেই। এটা পুরোপুরি মানসিকতা এবং প্রায়োরিটির বিষয়। মাতৃত্বের সিদ্ধান্ত নেওয়া মানেই যে ব্যক্তিগত জীবন নষ্ট হয়ে যাবে এমন কোন ব্যাপার নেই, এই ভাবনা যুক্তিহীন।
তাই প্রেগন্যান্সি কে টেকেন ফর গ্রান্টেড নেবেন না। হাতে এবং মনে সময় সুযোগ নিয়ে, ধীরে সুস্থে সিদ্ধান্ত নিন। এতে আপনার সন্তান একটি সুস্থ জীবন পাবে।
চিত্র সূত্র- pixabay.com
ধন্যবাদ।
চিত্র সূত্র- pixabay.com
Tags, মা ও শিশু, স্বাস্থ্য, মাতৃত্ব এবং বয়স
তথ্যসূত্র- টাইমস অব ইন্ডিয়া, আনন্দবাজার পত্রিকা,
বিদ্র: উপরের তথ্য গুলি কখনোই একজন প্রশিক্ষিত চিকিৎসকের চিকিৎসা সংক্রান্ত উপদেশ এবং বিকল্প নয়।
কোন মন্তব্য নেই: