সাফল্যময় জীবন পেতে অনুভব শক্তির ভূমিকা কতটা ?
পৃথিবীর প্রতিটা জীব যন্তুর মধ্যেই অনুভব শক্তি বিরাজমান।আমাদের সকলের জীবনে অনুভব একটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ। অনুভব ছাড়া আমাদের কোনও অস্তিত্বই নেই।একটা গাছ, লতাপাতা, কীটপতঙ্গ, জগতের সমস্ত প্রাণীর মধ্যেই অনুভব শক্তি জাগ্রত।আমাদের পরিবার, সমাজ ব্যবস্থা, দেশ, জাতি গঠনের ক্ষেত্রেও অনুভব শক্তির ভূমিকা অনস্বীকার্য।
অনুভব করার ক্ষমতা কম বেশি সকলের মধ্যেই আছে।অনুভব শক্তির ভিন্নতায় এক জন ব্যক্তির সঙ্গে আর একজন ব্যক্তির পার্থক্য সৃষ্টি হয়।যাঁর অনুভব শক্তি যেমন, সে তেমনি এই সমাজে অবদান রাখতে সক্ষম হবেন।
যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর চারপাশের জগত্ কে অনুভবের মধ্যে এনে রোমাঞ্চ সৃষ্টি করতে পারতেন।তাঁর মধ্যে অনুভব করার গুন না থাকলে সে কখনোই বিশ্ব কবি হতে পারতেন না।
ঠিক তেমনি প্রকৃতিতে অনন্ত সুর তো সর্বদাই ভেসে বেড়াচ্ছে, যাঁরা এই সুর কে হৃদয়ের মধ্যে ধারণ করতে পারেন একমাত্র তাঁরাই সংগীত কে ছুঁতে পারেন। যেমন তানসেন, বেটোভেন,হরিদাস প্রমুখ সংগীতজ্ঞ তাঁদের অনুভূতির মধ্যে এই সুর কে বাঁধতে পেরেছিলেন, তাই তাঁদের নাম আজও ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।
একজন চাষি ও যখন মাঠে কাজ করেন তখন সে তাঁর চাষের কাজেও এই অনুভূতি কে প্রযোগ করেই একটি জমিতে শস্য উত্পাদন করেন। প্রগাঢ় অনুভূতি ব্যতীত কোনও সৃষ্টিশীল কাজ ই সুসম্পন্ন হয় না।তাই অনুভব হল আমাদের চালিকাশক্তি যেটা ছাড়া আমরা কোনও কাজেই সফল হতে পারি না। আমাদের সমাজে বিশ্বকবি থেকে শুরু করে, ডাক্তার, মাস্টার, ছোটখাটো ব্যবসায়ী, পুলিশ, প্রশাসক,কৃষক, এমনকি কামার হতে গেলেও যথার্থ অনুভূতিসম্পন্ন নর-নারী হতেই হবে।
আজ যে নারী বিশ্ব সুন্দরী, সে কিন্তু একদিন হঠাত্ করে বিশ্ব সুন্দরীর খেতাব পায়নি।এই বিশ্ব সুন্দরী হওয়ার অনেক আগের থেকেই তাঁকে ঐ অনুভূতির মধ্যে বাস করতে হয়েছে।সে প্রতিনিয়ত ভেবেছে যে, সে একদিন বিশ্ব সুন্দরীর খেতাব অর্জন করবেই, তাঁর সেই ভাবনা,এবং ধৈর্য্য তাঁকে তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করেছে।
তাই, সাফল্যময় জীবন পেতে হলে সুন্দর অনুভূতি কে জাগিয়ে তুলতে হবে।মন সদা হাস্যউজ্বল, শান্তিময়, আনন্দে উচ্ছ্বসিত থাকা মানে আপনার মধ্যে ইতিবাচক অনুভূতি বিরাজমান।
আপনি কি জীবনে বিশেষ কিছু হতে চান? ছোট্ট এই জীবনে পৃথিবীতে কোনো বিশেষ অবদান রেখে যেতে চান? জীবনে কি হতে চান সেটা আগে ঠিক করুন,আপনার মধ্যে আপনি যেটা চান, সেটা হওয়ার সমস্ত শক্তি নিহত আছে,আপনাকে কেবল অনুভবের দ্বারা তাকে জাগিয়ে তুলতে হবে। আপনার স্বপ্ন কে কল্পনার জালে রঙিন করতে হবে,আপনার অনুভব শক্তি আপনার স্বপ্ন পূরণের সহায়ক হবে। আপনি যেটা হতে চান মনের মধ্যে সেই সব বিষয়ে স্বপ্ন রচনা করুন,স্বপ্ন টি নিয়ে দিবারাত্র ভাবতে থাকুন, সেই বিষয়ে প্রচুর বই পড়ুন, সেই বিষয়ে অভিজ্ঞ মানুষের সঙ্গ নিন,আলোচনা করুন। তাহলে দেখবেন সেই বিষয়ে আপনার অনুভব করার শক্তি দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে।
বর্তমানে বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে ভালো কিছু অনুভব করার ক্ষমতা টা লোপ পাচ্ছে।অনুভূতি সবার মধ্যে আছে,কিন্তু আপনি কেমন অনুভূতি সম্পন্ন মানুষ সেটা আপনি নিজেই নিজেকে বিচার করলে বুঝতে পারবেন।আপনার অনুভব ই আপনার চরিত্র, আপনার জীবন।আপনি প্রতিনিয়ত, প্রতিক্ষণে, প্রতি পদে যেটা অনুভব করেন আপনি সেটাই।
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন---
'যদি তুমি যিশুখ্রিষ্টের মতো অনুভব কর,তবে তুমি একজন যিশুখ্রিষ্ট হবে,বুদ্ধের মতো অনুভব কর, তুমি একজন বুদ্ধের মতো হবে।অনুভূতিই হল জীবন, মহত্ শক্তি,অপরিসীম প্রাণপ্রাচুর্য'।
তবে দুঃখের বিষয় দিনে দিনে মানুষের অনুভূতি টা ক্ষীণ হয়ে আসছে।মানুষের মানবিকতা বোধটা বড্ড কমে যাচ্ছে।আমি নিজে খুব অবাক হই এটা দেখে, একটা বাসে, ট্রেনে কিংবা বাজারে একজন অপরিচিত ব্যক্তি আর একজন অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে কোনো রকম একটু পায়ে পা লাগলে,বা কে আগে বসবে কে পরে বসবে এটা নিয়েও, কথা কাটাকাটি থেকে শুরু করে হাতাহাতি, সব ই ঘটে ঐ টুকু সময়ের মধ্যে।নিজের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে কতটা অসচেতন হলে এমনটা করা সম্ভব।আমার সঙ্গে কেউ খারাপ ব্যবহার করল বলে আমি যদি তাঁর সঙ্গে একই রকম ব্যবহার করি তাহলে তাঁর সঙ্গে আমার পার্থক্য টা থাকল কোথায়!যে ভালো তাঁর সঙ্গে তো আমরা ভালো ব্যবহার করি,এতে আর বিশেষত্ব কি? এতো সবাই করে।উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ হতে হলে ভিরের মাঝ খান থেকে বেরিয়ে একটু আলাদা ভাবতে হবে, আলাদা কিছু করতে হবে।আর একটু ভিন্ন ভাবে ভাবতে পারলে অপরের ভালোর থেকে নিজের ভালো বেশি হয়।
আমি কারও সঙ্গে খারাপ আচরণ করব না, কারণ আমি নিজে ভালো থাকতে চাই,আমি আমার দেহ ও মনের উন্নতি করতে চাই। জীবন টা খুব সমীত, এটা কে উপভোগ করতে হবে,অন্যের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় লিপ্ত থাকলে জীবন কে উপভোগ করার সময় কমে যাবে। যতক্ষণ আমাদের জীবন আছে ততক্ষণ সেখানে কেবল ভালো অনুভব শক্তি কে জাগ্রত করতে হবে।জীবন ই অনুভব, অনুভব ই জীবন।শুভ অনুভব ই ভালোবাসা, ভালোবাসাই যথার্থ অনুভব।
তাই আমাদের অশুভ চিন্তা- ভাবনা, ঘৃণা, দ্বেষ,অসন্তোষ, রাগ, বিরক্তি, হিংসা সমস্ত নেতিবাচক ধ্যান ধারণা কে সরিয়ে, গঠনমূলক চিন্তা ভাবনা, ভালোবাসা, আবেগ, সহানুভূতি, সহমর্মিতা, বন্ধুত্ব পূর্ণ আচরণ অন্তরের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। যত বেশি আমরা সকলের প্রতি ভালোবাসা অনুভব করব,তত বেশি আমরা ভালো থাকব, আনন্দে উচ্ছ্বসিত থাকব, হৃদয়ের মধ্যে শুভ চিন্তার প্রবেশ ঘটবে, আমরা স্বাস্থ্যবান থাকতে পারব।
কারণ আমরা যা অনুভব করি সেটাই তো আমাদের জীবন। আপনি যদি ভালোবাসা অনুভব করেন, তবেই আপনি আপনার চারপাশে ভালোবাসা কে ছড়িয়ে দিতে পারেন।আপনি যখন শুভ চিন্তা করেন তখন আপনার সেই শুভ চিন্তার প্রতিফলন আপনার চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আপনি যদি আনন্দে থাকেন তখন আপনি সব কিছু তেই আনন্দিত হন।
আবার অপর দিকে আপনি লক্ষ্য করবেন,আপনি যখন নেতিবাচক চিন্তার মধ্যে থাকেন তখন আপনার সামনে কেবলই নেতিবাচক ঘটনাই ঘটে। আপনি যদি কারো সম্পর্কে নেতিবাচক চিন্তা করেন তাহলে তারপর থেকে সেই মানুষ টার সমস্ত নেতিবাচক বিষয় গুলিই আপনার সামনে উঠে আসবে। আসলে আমরা যখন যেটা অনুভব করি তখন সেই বিষয় টাই আমাদের কে আচ্ছন্ন করে।
আমাদের অনুভবে মধ্যে যদি উত্সাহ, উদ্দীপনা, আশা, আদর্শবোধ, শুভ বুদ্ধিতে ভরপুর থাকে, তাহলে আমাদের ব্যক্তিত্বে আকৃষ্ট হয়ে সকলেই আমাদের কাছে আসবে।আমি একটা সুন্দর পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হব।আমার চিন্তাধারায় অন্যেরা উপকৃত হবে।আমার নিজের প্রতি নিজের মূল্যবোধ বাড়বে। আমি এই সমাজে একটা অবদান রেখে যেতে পারব। এর থেকে জীবনে ভালো কি কিছু হয়।
জনতার ভিরে মুখ হয়ে বেঁচে থেকে কি লাভ! বাঁচতে হলে এমন ভাবে বাঁচতে হবে, যাতে এই পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার সময় কোন অনুশোচনা না থাকে। কোনও মানুষ মারা যাওয়ার শেষ চল্লিশ সেকেন্ড খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেই সময় বিগত সারা জীবনের হিসাব চোখের সামনে ভেসে উঠবে। শুভ কাজে,সুচিন্তায়,সুভাবনায় দিন কাটালে সেদিন মরন টা হবে শান্তির । তাই আবেগপ্রবণ হয়ে এমন কোনও কাজ করব না,যার জন্য ঐ শেষ সময় অনুতাপ অনুভব করি। তাই প্রতিটা পদক্ষেপ ফেলার আগে অনেক ভাবনা চিন্তার প্রয়োজন। আজকের ভাবনা যেন আগামী দিনের কাঁটা না হয়ে দাঁড়ায় সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
পৃথিবীর মহান মহান ব্যক্তি বর্গ কেনো সব সময় ভালো কাজে, সমাজ সেবার কাজে যুক্ত থাকেন? কেনোই বা তাঁদের উপার্জনের বেশি ভাগটাই হত দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য দিয়ে দেন? বিল গেটস থেকে ওয়ারেন বাফেট, রতন টাটা থেকে এ পি জে আবদুল কালাম স্যার সমস্ত মহান ব্যক্তিই তাঁদের উপার্জনের বেশি ভাগ ই এই সমাজের মানুষের উপকারে লাগিয়েছেন। কারণ তাঁদের অনুভব শক্তি এই পৃথিবীর ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে জাগ্রত। তাঁরা জানেন তাঁদের কাজ টা এই পৃথিবীতে থেকে যাবে তাঁরা নন।
তাঁদের সাফল্যমণ্ডিত জীবনে অনুভব শক্তিই ছিলো, তাঁদের চালিকাশক্তি। তাঁরা অনুভবের উপর ভর করেই জীবনের শীর্ষতম স্থানে যেতে সক্ষম হয়েছেন।
তাই সাফল্য অর্জন মানে শুধু অর্থ নয়, জীবন নামক তরীতে তখনই সাফল্য এসেছে বলা যায়, যখন অর্থের সঙ্গে, আমি আমার পরিবার, বন্ধু বান্ধব, আত্মীয়স্বজন, আমার ইচ্ছা, আমার সখ,আল্লাদ, সমস্ত কিছু তেই আনন্দ অনুভব করতে পারব। আমি সব কিছু কে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতে পারব।
জীবনে এই সব কিছুই পাওয়া সম্ভব, কেবলমাত্র একটি সুন্দর, মিষ্টি,অনুভবের দ্বারাই।জীবনে অনুভূতির জগত্ কে সততার সঙ্গে প্রসারিত করতে গেলে,প্রয়োজন হল তিন টি 'সু'- তা হল সুষম খাদ্য, সুমিষ্টি হাসি, এবং সুনিদ্রা।পৃথিবীর সকল প্রাণীর মধ্যে শুভ চিন্তা র সূচনা হোক, সকলে তাঁর চারিপাশে আনন্দময় প্রাণশক্তিতে ভরিয়ে তুলুক, সবার শুভ অনুভব শক্তি জাগ্রত হোক এই প্রার্থনাই করি।
ধন্যবাদ 😊😊
কোন মন্তব্য নেই: