অরগ্যানিক খাদ্য কি?সুস্বাস্থ্য রক্ষায় অরগ্যানিক ফার্মিং এর প্রয়োজনীয়তা কতটা?
অরগ্যানিক খাদ্য কি:
কোনও কীটনাশক ব্যবহার না করে কৃত্তিমতা বর্জন করে প্রাকৃতিক উপায়ে ফসল ফলানোর পদ্ধতিকে বলা হয় অরগ্যানিক ফার্মিং।বাংলায় আমরা যাকে বলি জৈব চাষ।
আমাদের ব্যস্তময় জীবনে সুস্থ থাকতে শাক সবজির প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।এমনিতেই চারিদিকে দূষণের শেষ নেই।ঘরের বাইরে বার হলেই প্রতিনিয়ত কিছু না কিছু দূষণ শরীরের মধ্যে প্রবেশ করছেই। তার উপর আছে খাদ্যাভ্যাস নিয়ে নানা ঝামেলা।
বর্তমানে সব খাবার ই প্রায় তার স্বাদ হারিয়েছে এ কথা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। এখন কোনও খাবারই আগের মতো সুস্বাদু নয়। পুকুরের মাছ থেকে মাঠের সবজি, বাদ যায় না ফল মূল ও সবেতেই রাসায়নিক সার এবং নানা কীটনাশক ব্যবহারে ফলে সবজির নিজস্ব স্বাদের দফারফা। এখন সকলের মুখেই একটা কথা খুব শোনা যায়, খাবার আজকাল বড় বিস্বাদ!
এখন আর সেই পুরনো দিনের মতো শীত কালে নলেন গুড়ের সুবাস ছড়ানো গন্ধ টা আর নেই।প্রাকৃতিক মধু তার জৌলুস হারিয়েছে।এখন আমরা খায় অনেক কিছু কিন্তু সাধ নেই কোন কিছুতেই।
বর্তমানে মানুষ খুব বেশি পরিশ্রম করা থেকে বিরত থাকে।এবং প্রায় চাষি খুব তারাতারি অধিক ফসল ফলানোর চিন্তায় বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ, বিভিন্ন কীটনাশক জমিতে প্রয়োগ করে লাভ জনক উপায় অবলম্বন করতে গিয়ে শরীরে প্রবেশ করাচ্ছে বিষক্রিয়া।
আগে যে জমিতে বছরে দুবার চাষ হতো এখন সেই জমিতে বিভিন্ন রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে অধিক বার ফসল ফলাচ্ছে ,যার ফলস্বরূপ শরীরে বাসা বাঁধছে নানাবিধ রোগ।
প্রতিটি ঘরে উঁকি দিলে চোখে পড়বে বিভিন্ন রোগের রমরমা।এমন কোন পরিবার নেই যে, সে পরিবারে রোগ নেই।বাচ্চা থেকে বড় সবাই কোন না কোন রোগের কবলে জর্জরিত।
কারণ এখনকার দিনে বেশিরভাগ সবজিই হাইব্রিড, যেটা শরীরের জন্য ভীষণ ই ক্ষতিকর।
ফলে, ফুল কপি তার রূপ রং ধরে রেখেছে বটে, কিন্তু স্বাদ টা হারিয়ে ফেলেছে, এই তালিকায় বাদ যায় না কোনও সবজিই।বাজারে গিয়ে সবজি দেখে বেশ আনন্দ লাগে। খুশি হয়ে গদগদ মনে বেশ লাল লাল দেখে টমেটো, সবুজ পটল, সবুজে ভরা উচ্ছে দেখে ব্যাগে ভরতি করে আনতে বেশ মজা লাগে।কিন্তু সব কিছুই যে বিষে ভরপুর সে খবর কি আমরা রাখি?
পটল,উচ্ছে, টমেটো সবেতেই দিচ্ছে দেদার রং! তার উপর আছে অতিমাত্রায় কীটনাশক এর ব্যবহার।ফলে রোগ জীবাণু শরীরে বাসা বাঁধতে একটু ও দেরি করছে না। এই সব কিছুর হাত থেকে রেহাই পেতে অরগ্যানিক খাবার কে বরণ করতেই হবে।
যদিও সাধারণ মানুষের পক্ষে অরগ্যানিক খাবার খাওয়া টা খুবই কষ্ট সাধ্য ব্যাপার।কিন্তু রোগমুক্ত হয়ে দীর্ঘ দিন বাঁচতে গেলে মাঝে মাঝে হলেও অরগ্যানিক সবজি খেতেই হবে। দরকার পড়লে পোশাকে আপস করতে হবে কিন্তু স্বাস্থ্যসম্মত খাবারে নয়। আজ দামি পোশাক পড়ে কম দামে বিষে ভরা খাবার খেলে পরবর্তীতে শরীর পড়বে রোগের কবলে।
তখন আর দুঃখের শেষ থাকবে না।পরে কিন্তু দামি ওষুধ কিনতে চলে যায় প্রচুর টাকা।সঙ্গে থাকে রোগের উপদ্রব।কিন্তু এখন যদি একটু সচেতন হওয়া যায় তাহলে পরবর্তীতে নীরোগ জীবন যাপন করা সম্ভব হবে।
কিভাবে আপনি দীর্ঘ দিন নীরোগ থাকবেন তা জানতে আরও পড়ুন----
জৈব চাষ বাড়াতে সরকারি উদ্যোগ ভীষণ ই প্রয়োজন।এই চাষে মানুষকে আগ্রহী করার জন্য জোরকদমে প্রচার চালাতে হবে।সাধারণ চাষিকে বোঝাতেে হবে জৈব চাষের উপকারিতা সম্পর্কে। সরকারি তরফ থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।
মানুষ সুস্থ ভাবে জীবন যাপন করতে না পারলে পরবর্তী পৃথিবীর জন্য সেটা হবে ক্ষতিকারক।তাই অরগ্যানিক খাদ্য উৎপাদনে সকলের সচেতনতা ভীষণ ভাবে প্রয়োজন। পৃথিবীর উন্নত দেশে এ চাষ বহু বছর ধরে প্রচলিত। 2000 সাল থেকে আমাদের দেশেও চালু হয়েছে এই পদ্ধতিতে চাষ। দক্ষিণ ভারতেে আগেই এর জনপ্রিয়তা বেড়েছে।এখন আমাদের এখানেও অস্তে অস্তে জনপ্রিয়তা লাভ করছে।
অরগ্যানিক পদ্ধতি তে চাষ সম্পূর্ণ কেমিক্যাল কীটনাশক মুক্ত।কোনও কেমিক্যাল সার ই ব্যবহার করা হয় না। এই চাষে পুরোপুরি জৈব সার ব্যবহার করা হয়।মূলত পাহাড়ি অঞ্চলে সাধারণ জৈব চাষের প্রচলন।
এই অঞ্চলের চাষিরা অনেক বছর ধরে বংশ পরম্পরায় জৈব চাষের সঙ্গে যুক্ত। তাঁরা খুব অল্প হারে জৈব চাষ করে। এঁরা মূলত নিজেদের খাওয়ার জন্যই ফসল টা ফলান।তবে যেটুকু বাড়তি হয়,সেটুকু বাজারে বিক্রি করে কিছু উপার্জন করেন।
এঁরা রাসায়নিক সার একদমই প্রয়োগ করে না।তবে এঁরা খুুুব বেশি মাত্রায় ফসল ফলায় না।ফলে এঁদের বিশাল মার্কেট ও নেই এই ফসলের।
অরগ্যানিক চাষের পদ্ধতি:
বিগত কয়েক দশক ধরে উন্নত পৃথিবী যেমন, ইউরোপ, আমেরিকার বিভিন্ন দেশ অরগ্যানিক ফার্মিং এর প্রচলন শুরু করেছে।সম্প্রতি আমাদের দেশ ও এই পদ্ধতিতে ফসল ফলানোর পথে হাঁটতে শুরু করেছে।এই পদ্ধতির নাম অরগ্যানিক সার্টিফিকেশন মেথড।বাংলায় যাকে বলে শংসিত জৈব চাষ।
তবে অরগ্যানিক সার্টিফিকেশন মেথড পদ্ধতিতে চাষ করার কিছু নিয়ম আছে।এই উপায়ে চাষ করার জন্য একটা থার্ড পার্টির প্রয়োজন হয়।তাঁরা কোন একটা বা একাধিক জমি পর্যবেক্ষণ করে যদি বলেন সেই জমি জৈব চাষের উপযুক্ত তাহলে সেই জমিতে যে ফসল ফলানো হয় তা অরগ্যানিক ফার্মিং হিসাবে গণ্য করা হয়।
আরও বিস্তারিত ভাবে বলতে গেলে, কোন জমি জৈব চাষের উপযুক্ত তা পর্যবেক্ষণ করে এন পি ও পি বা ন্যাশনাল প্রোগ্রাম ফর অরগ্যানিক প্রোডাকশন।কোনও চাষি অরগ্যানিক ফার্মিং এর জন্য আগ্রহী হলে তাঁকে এই সংস্থার অধীনে নাম নথিভুক্ত করাতে হবে।তার পর আছে জমি পরীক্ষা।এই সংস্থা যদি ঐ জমিতে জৈব চাষের উপযুক্ত বলে মনে করে তবেই জৈব চাষ করার জন্য ছাড়পত্র পাবে।এবং ঐ জমিতে উত্পাদিত ফসল ইন্ডিয়া অরগ্যানিক লোগো ব্যবহারের সম্মতি পাবে।
সম্প্রতি বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় অরগ্যানিক ফার্মিংয়ের অনুমতি পেয়েছে।তাঁরা কোনও প্রকার কেমিক্যাল ছাড়া 100% স্বাস্থ্যসম্মত ভাবে গোবিন্দ ভোগ,রাধা তিলক,রাঁধুনি পাগল ইত্যাদি ধান চাষ শুরু করেছে।
এই চাষ করতে গেলে কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলতে হয়।যে জমিতে অরগ্যানিক চাষ হবে তাতে তো কোনও রকম কেমিক্যাল ব্যবহার করা যাবেই না এবং উপরন্তু সেই জমি সংলগ্ন কোনও পুকুর বা খামার থাকলে সেখানেও কেমিক্যাল ব্যবহার করা যাবে না।এছাড়া এই জমির চারপাশের আল ও দুই তিন ফুট উঁচু করতে হয়।নাহলে ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে পারে।
এই পদ্ধতিতে চাষে যদি ফসলে পোকা ধরে তাহলে তা মারার জন্য নিম, হলুদ, রশুন গোবর কম্পোস্টিং , তামাক পাতা, সরষের খোল ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। এগুলো আবার অরগ্যানিক কীটনাশক, যা বাজার থেকে কেনা যায় না।এগুলো ঐ জমিতে ই ফলিয়ে নিতে হয়।
অরগ্যানিক চাষ বা জৈব চাষ করা হয় রাসায়নিক বিহীন,কৃত্তিম সার- রং কীটনাশকের বালাই নেই।সুবিস্তৃত শস্যখেত পরখ করে পরম আদর যত্নে লালিত হচ্ছে পটল, বেগুন, ব্রকোলি, টমেটো, পালংশাক।
অরগ্যানিক খাদ্য চেনার উপায়:
আসলে ইন্ডিয়ান অরগ্যানিক লোগো না থাকলে সেই খাবার জৈব কিনা তা বোঝা সম্ভব নয়।তাই ইন্ডিয়ান অরগ্যানিক লোগো থাকলে সেটাই অরগ্যানিক খাবারের তকমা পাবে।
এই ফসল সাধারণ বাজারে পাওয়া যায় না।এগুলো সাধারণত সব বড় বড় ফুড মার্কেট এ অরগ্যানিক প্রোডাক্ট পাওয়া যায়।
এছাড়া বিগ বাজার, স্পেনসার'স এর মতো শপিংমল এ পাওয়া যায়।কলকাতায় নিউ মার্কেটের কিছু বড় রিটেলারের কাছে পাবেন।পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলাতেও বড় রিটেলাররা অরগ্যানিক খাবার বিক্রি করে।
চিত্রসূত্র- pixabay.com
বর্তমানে মানুষ সুস্থ ভাবে বাঁচ তে অরগ্যানিক খাবারের দিকে বেশি ঝুঁকছে।এমনিতেই জীবন যাপনের ধরন অনেক টা পাল্টেছে তার উপর খাদ্যাভ্যাসে আপস না করাই ভালো। এছাড়া এই চাষের পুরো প্রক্রিয়াটি পরিবেশ সহায়ক।
অরগ্যানিক পদ্ধতিতে বিভিন্ন ধরনের সবজি যেমন, ফুলকপি, গাজর,মুলো,সিম,পালংশাক, বাঁধা কপি,সরষে এবং বিভিন্ন ফল,দুধ,নারকেল, লেটুস,বেসলি,কেল সব ই এখন উত্পাদন হচ্ছে।এছাড়া এখন অরগ্যানিক প্রক্রিয়ায় পাশের খামারেই শোভা পাচ্ছে গরু, মুরগিরা,এবং ডিম ও উত্পাদনে জোর দেওয়া হচ্ছে।
এই চাষে ইউরিয়া ও পুরোপুরি নিষিদ্ধ।এতে কোনও পেস্টিসাইড থাকে না।অরগ্যানিক খাবারে প্রেজারভেটিভ ও প্রায় থাকে না বললে চলে।অরগ্যানিক ফুড প্রসেসিংয়ের সময় সিন্হেটিক ফুড অ্যাডিটিভস ও দেওয়া হয় না।চাষের পুরো-প্রক্রিয়াটি পরিবেশ বান্ধব,এতে কোন রকম পেস্টিসাইড থাকে না।
সব কৃত্তিমতা বর্জন করে প্রাকৃতিক উপায়ে রাসায়নিক সার বিহীন, কীটনাশকের বালাই ছাড়া ফসল উত্পাদন হয় বলে, এই খাবার কে সুস্বাস্থ্যের চাবিকাঠি বলা চলে।মূলত অরগ্যানিক ফার্মিং এর যাবতীয় নিয়ম মেনে যে খাবার চাষ করা হয় সেগুলো কেই বলে জৈব চাষ।
তাই সুস্থ থাকতে অরগ্যানিক খাবার ভীষণ ই উপকারী এবং অরগ্যানিক ফার্মিং এর প্রয়োজনীয়তা ও ব্যাপক।
আরও পড়ুন--
আমার দেওয়া তথ্য যদি আপনার উপকারে আসে তাহলে একটা কমেন্টস করতে ভুলবেন না।এর সবাই কে সচেতন করতে বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করুন।
চিত্রসূত্র- pixabay.com
তথ্যসূত্র সংগৃহীত
Tags, অরগ্যানিক ফুড
ধন্যবাদ 😊
কোন মন্তব্য নেই: